জানতে হবে সঠিকভাব শামীমা
বিনতে নূর
দ্বীনী ইলম অর্জন করা প্রতিটি মুসলিম
নর-নারীর উপর ফরয। হাদীস শরীফে আছে, ইলম অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য
অপরিহার্য।
দ্বীনী ইলম ছাড়া দ্বীনের উপর চলা সম্ভব নয়।
আল্লাহ তাআলার দেওয়া হুকুম-আহকাম পালন করতে হলে প্রথমেই তা জানতে হবে এবং
সঠিকভাবে জানতে হবে। এ কারণে জানার সূত্রটিও সঠিক ও নির্ভরযোগ্য হওয়া জরুরি। বিখ্যাত মনীষী
মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন রাহ. বলেছেন, ইলম হচ্ছে দ্বীন। অতএব
তোমরা ভালোভাবে লক্ষ্য কর, কার নিকট থেকে তা গ্রহণ করছ।
আমাদের সামনে জ্ঞানের অনেক সূত্র আছে। যেমন-
|
MD RIAZ UDDIN |
১. জ্ঞানী ব্যক্তির সাহচর্য। আমি যে বিষয়ের
জ্ঞান অর্জন করতে চাই সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞের কাছেই আমাকে যেতে হবে। আমার প্রয়োজন
চিকিৎসকের পরামর্শ,
কিন্তু আমি গেলাম প্রকৌশলীর কাছে, তাহলে এটা
হবে নির্বুদ্ধিতা। তাই দ্বীনী ইলমের কোনো বিষয়ের সমাধানের জন্য আমি দেখব, দ্বীনী বিষয়ে কে বিশেষজ্ঞ। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট, বিদেশী ভাষার দক্ষতা ইত্যাদি অপ্রাসঙ্গিক। দ্বীনী বিষয়ের সমাধানের জন্য
আমাকে একজন মুত্তাকি ও মুহাক্কিক-পরহেযগার ও বিশেজ্ঞ আলিমের শরণাপন্ন হতে হবে।
২. জ্ঞানের দ্বিতীয় সূত্র বইপত্র। এখানেও
দেখতে হবে বইটি কার লেখা?
বইয়ের বিষয়বস্ত্ত কী? বইটি যিনি লিখেছেন
তিনি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কি না। আজকাল তো দেখা যায়, নামায
বিষয়ে বই লিখছেন প্রকৌশলী ও চিকিৎসক মহোদয়গণ! আর সেসব বইয়ে তারা ভুল ঠাউরাচ্ছেন
আলিমদের সিদ্ধান্তকে। তাই দ্বীনী বই পড়ার আগে আমাদের কর্তব্য, দ্বীন ও শরীয়তের বিশেষজ্ঞ আলিমদের সাথে পরামর্শ করা।
৩. জ্ঞানের একটি আধুনিক মাধ্যম ইলেক্ট্রনিক
মিডিয়া। যেমন,
বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, ইন্টারনেটের বিভিন্ন
ওয়েবসাইট ইত্যাদি। এখানেও ইসলাম ও ইসলামের বিভিন্ন বিধান সম্পর্কে আলোচনা,
পর্যালোচনা, সাক্ষাতকার, সরাসরি প্রশ্নোত্তর ইত্যাদি থাকে। সাধারণ লোকজন এসব মাধ্যম থেকে অনেক কিছু
গ্রহণ করে। এখানেও একই মূলনীতি প্রযোজ্য।
একটা সময় ছিল যখন মানুষ ছাপার অক্ষরকে সকল
ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে মনে করত। অর্থাৎ যা ছাপার হরফে এসেছে তাকে মনে করত
নিশ্চিতভাবে নির্ভুল। তাই কেউ আপত্তি করলে বলত, এটা তো অমুক বইয়ে লেখা আছে। এখন যুগ
পাল্টেছে। এখন সাধারণত মানুষ ছাপার অক্ষরকে নির্ভুল মনে করে না। এখন নির্ভুল মনে
করে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত কথাবার্তকে। অজ্ঞতার আধুনিক সংস্করণ আর কি। এ
কারণে কোনো ভুল তথ্যের উপর আপত্তি করলে অনেকে বলে, টিভিতে
বলেছে! যেন টিভিতে বলা সব কথা একশভাগ সঠিক!
ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বলুন, প্রিন্ট মিডিয়াই বলুন,
এসব তো প্রচারমাধ্যম। এখানে শুদ্ধটা প্রচার করলে শুদ্ধ আবার অশুদ্ধ
প্রচার করলে তা অশুদ্ধ। মিডিয়া তো এমন অলৌকিক কোনো বিষয় নয় যে, তাতে ভুল ও অশুদ্ধ তথ্য পরিবেশন করা হলেও তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সঠিক ও
শুদ্ধ হয়ে যাবে। তাই মিডিয়ায় প্রচারিত হওয়াই শুদ্ধাশুদ্ধির মাপকাঠি নয়।
আমাদেরকে অবশ্যই যাচাই করে দেখতে হবে, বিশেষজ্ঞরা এ সম্পর্কে
কী বলেন। সুতরাং এখানেও অভিজ্ঞ দ্বীনদার আলেমের কোনো বিকল্প নেই।
এই কথাগুলো বললাম কয়েকটি ঘটনার কথা মনে
পড়ায়। এবার ঘটনাগুলো শুনুন।
কয়েক মাস আগে আমার প্রতিবেশীর বাবা ইন্তেকাল
করেছেন। বাবার মৃত্যুর মাসখানেক পর তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভাবী! পিতার মৃত্যুর ৩ মাস
১০ দিনের মধ্যে কি ছেলে বিয়ে করতে পারে? আমি বললাম, বিয়ে করলে সমস্যা আছে, এই কথাটা আপনি কোথায় পেলেন?
তিনি বললেন, টিভিতে বলেছে। জিজ্ঞাসা
করলাম, কে বলেছে? বললেন, উনার নামটা আমার পুরাপুরি মনে নেই। তবে তিনি একজন বড় আলেম।
তাঁর কাছেই আরেকবার শুনেছিলাম। টিভিতে বলেছে, যারা মিথ্যা কথা বলে তাদের
ঈমান নেই। আর ঈমান যদি না থাকে তাহলে জানাযা-দাফনের দরকার কী? জানতে চেয়েছিলাম, কে বলেছে? তিনি
নামকরা একজনের কথা বললেন, যার নামটি আমি এখানে উল্লেখ করলাম
না।
আরেকজন বললেন, টিভিতে অনেক বড় আলেমের কাছে
শুনেছি, পর্দা করার জন্য চেহারা ঢাকা জরুরি নয়। চেহারা খোলা
রেখে হিজাব পরে পর্দার হুকুম পালন করা যায়।
এ রকম আরো অনেক কথা বিভিন্ন সময় শোনা যায়, যা নাকি টিভিতে সরাসরি
প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বলা হয়। একজন তো বলছিল, টিভিতে বলেছে,
কুরআন মজীদ তোতা পাখির মতো পড়ে পড়ে কী লাভ, আরবী
শুধু পড়লেই হল, অর্থ জানা হল না। হতে পারে আরবীতে গালিগালাজ
দেওয়া আছে। তাই অর্থ বুঝতে হবে। অর্থ না বুঝে পড়াতে কোনো সওয়াব নেই।
এ ধরনের প্রচুর কথাবার্তা লোকজন টিভি থেকে
শুনে এসে কথায় কথায় ব্যবহার করতে থাকেন। তারা বিশ্বাস করেন, টিভিতে যিনি বলছেন, তিনি অনেক বড় আলেম। আমাদের প্রথমেই জানতে হবে, বড় আলেম
নির্ণয়ের মানদন্ড কী? বড় আলিমের মানদন্ড কি টিভিতে আসা?
টিভিতে আসার অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। অনেকেই টিভিতে আসতে পারেন,
যোগ্য লোকও আসতে পারেন। অযোগ্য লোকও আসতে পারেন। তাই টিভিতে আসা বা
আসতে পারাটাই যোগ্যতার মাপকাঠি নয়।
কেউ কেউ সুন্দর চেহারা ও পরিপাটি সজ্জা
দ্বারা প্রভাবিত হন,
কেউ প্রভাবিত হন বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা বা সাবলীল উপস্থাপনার দ্বারা।
এগুলো মানুষের গুণ এবং প্রশংসনীয়, কিন্তু শুদ্ধাশুদ্ধির
মাপকাঠি নয়।
তাই শুদ্ধ ও সঠিক বিষয়টি জানতে হলে আমাকে
অবশ্যই যেতে হবে একজন দ্বীনদার আলিমের কাছে। তিনি হাদীস-কুরআনের উদ্ধৃতিসহ বুঝিয়ে
দিবেন কোনটি সঠিক,
কোনটি ভুল। অথবা তিনি এমন কোনো প্রাজ্ঞ আলিমের সন্ধান দিবেন,
যার কাছে পাওয়া যাবে যে কোনো দ্বীনী সমস্যার সমাধান। আসলে বড় আলিম
তিনিই, যার আছে কুরআন ও হাদীসের গভীর জ্ঞান। হতে পারে দেখতে
তিনি অতি সাধারণ, তার সাজ হয়ত নিতান্তই সাদামাটা। কিন্তু
তিনি অনেক বড় শায়খের শাগরিদ। তাঁরই নিকট ভিড় জমে প্রকৃত ইলম অন্বেষী-সচেতন
ছাত্রদের এবং আলিমরাও তাঁর কাছে উপস্থিত হন শাস্ত্রীয় জটিলতার সমাধান পেতে। এমন
ব্যক্তি কোথায় আছেন সেটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমাদেরই। এরই নাম ‘ইলম-অন্বেষণ’।
সূত্রঃ মাসিক আল কাউসার